দেওয়ানী মামলার ধাপসমূহ বা দেওয়ানী মামলা দাখিলের নিয়ম
১। মামলা ফাইলিং
২। সমন ফেরত
৩। এডি ফেরত
৪। লিখিত জবাব
৫। বাদীর সাক্ষী ও জেরা
৬। বিবাদীর সাক্ষী ও জেরা
৭। যুক্তিতর্ক
৮। রায় ও ডিক্রি
১ম ধাপ- মামলা ফাইলিং (Filing of suit)
মামলার ফাইল প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট কোর্টে সাবমিট করা হলো মামলা ফাইলিং। মামলা ফাইলিং এর জন্য নিম্নলিখিত কাগজপত্র একত্রিত করে আদালতের সেরেস্তাদারের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। মামলা ফাইলিং এর সময় নির্ধারিত অথবা এডভ্যালুরেম কোর্ট ফি স্ট্যাম্পের মাধ্যমে প্রদান করতে হয়। আদালতে মামলা ফাইলিং করতে কোর্ট ফি এবং বিজ্ঞ আইনজীবীর ফি ছাড়া আর কোন টাকা লাগে না। ইহা ছাড়া অন্য কেহ টাকা দাবি করলে তাহা অবৈধ। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সমূহ-
- আরজি লিখে কার্টিজ পেপারে প্রিন্ট করে কোর্ট ফি লাগাতেহবে। আরজিতে বাদী পক্ষের স্বাক্ষর নিতে হবে। আরজির প্রতি পৃষ্ঠা ৩ টাকা হিসাবে আরজির প্রথম পৃষ্ঠায় কোর্ট ফী লাগাটে হোবে।
- ওকালতনামা পূরণ করে বাদীর স্বাক্ষর নিতে হবে।
- প্রসেস ফি।
- সকল সাপোর্টিং ডকুমেন্ট ফিরিস্তিসহ প্রস্তুত করতে হবে।
এই গুলো প্রস্তুত করে সুতা দিয়ে সেলাই করে এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতের সেরেস্তাদারের নিকট উপস্থাপন করলে তিনি একটি মামলা নম্বর দিয়ে পরবর্তী তারিখ জানিয়ে দিবেন।
মামলা ফাইলিং এর ধারা দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ১৫ – ২৬ ধারা
ধারা ১৫: অর্থিক ও আঞ্চলিক এখতিয়ার সম্পন্ন সর্বনিম্ন আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করিতে হইবে।
ধারা ২৬: আরজির মাধ্যমে দেওয়ানী মোকদ্দমা রুজু করতে হবে।
২য় ধাপ- সমন ফেরত (Services of summon)
এই ধাপে সকল বিবাদীর প্রতি সমন প্রেরণ করতে হয়।
সমন প্রেরণ এর ক্ষেত্রে দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর আদেশ ৫ অনুসরণ করা হয়।
৩য় ধাপ- এডি ফেরত
এই ধাপে এডি আদালতে জমা দিতে হয়।
৪র্থ ধাপ- লিখিত জবাব দাখিল (Written statement submission)
সমন পাওয়ার পর এই ধাপে বিবাদী লিখিত জবাব দাখিল করে।
লিখিত জবাব দাখিল এর ক্ষেত্রে দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর আদেশ ৮ অনুসরণ করা হয়।
এছাড়াও এই ধাপে বিবাদী আদেশ ৭ এর বিধি ১১ মোতাবেক আরজি খারিজের আবেদন করতে পারে।
আরজি খারিজের আবেদন মঞ্জুর আদেশটি ২ ধারা মোতাবেক ডিক্রি বিধায় এই আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করতে হয়। আরজি খারিজের আবেদন নামঞ্জুর আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন করতে হয়।
ধারা ৩০ এর ব্যবস্থা-
ধারা ৩০: আদালত যেকোনো সময় স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া বা কোনো পক্ষের আবেদনক্রমে প্রশ্নামালা দাখিল, জবাবদান, দলিল দাখিল, উদঘাটন ও পরিদর্শনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যক্তিকে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন দিতে পারেন।
আদেশ ৮ বিধি ১: সমন জারির তারিখ হইতে ৩০ দিনের মধ্যে লিখিত জবাব পেশ করিতে হইবে। তবে সংগত কারণ থাকিলে আদালত সময়সীমা আরো ৩০ দিন বর্ধিত করিতে পারিবেন। কিন্তু তাহা সর্বসাকূল্যে ৬০ দিন অতিক্রম করিবে না। নির্ধারিত সময়ে লিখিত জবাব দাখিলে ব্যর্থ হইলে আদালত এক তরফা নিষ্পত্তি করিবেন।
[এক তরফা নিষ্পত্তি হইলে প্রতিকার রিভিশন। কারণ ৪৩ আদেশ মোতাবেক ইহা আপীলঅযোগ্য আদেশ]
৫ম ধাপ- বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR):
বিবাদী তার লিখিত জবাব দাখিল করার পর, উভয় পক্ষ আদালতে উপস্থিত হলে, আদালত মামলার শুনানি স্থগিত করে ধারা 89A অনুযায়ী আদালতের বাইরে মধ্যস্থতার মাধ্যমে পক্ষের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করবে।
৬ষ্ঠ ধাপ- চূড়ান্ত শুনানির তারিখ নির্ধারণ (Settling Date/SD)
বাদীর সাক্ষী ও জেরা (Examination and cross examination)। এই ধাপে বাদী সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা করা হয়।
৩০ ধারার ব্যবস্থা নেওয়ার পর আদালত মামলার চূড়ান্ত শুনানির দিন ধার্য করবেন। দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর আদেশ ১৪ -এর বিধি 8 অনুসারে, মামলার চূড়ান্ত শুনানির তারিখটি ইস্যু তৈরির 120 দিনের মধ্যে স্থির করতে হবে।
৭ম ধাপ- বিবাদীর সাক্ষী ও জেরা (Examination and cross examination)
এই ধাপে বাদী সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা করা হয়।
৮ম ধাপ- যুক্তিতর্ক (Argument)
উভয় পক্ষের সাক্ষী ও জেরা শেষ হলে যুক্তিতর্ক শুরু হয়। এই ধাপে উভয় পক্ষের আইনজীবী তাদের বক্তব্য আদালতে পেশ করেন।
৯ম ধাপ- রায় ও ডিক্রি (Judgment and Decree)
এই ধাপে আদালত রায় ও ডিক্রি প্রচার করেন।
(III) আর্থিক এখতিয়ার (Pecuniary Jurisdiction):
কোন আদালত কত টাকা মূল্যমানের মোকদ্দমার বিচার করতে পারবেন তাহা “দেওয়ানী আদালত আইন, ১৮৮৭” বা Civil Courts Act, 1887 (Amendment 2021) এর ১৯ ধারায় বর্ণিত বিধান অনুযায়ী আর্থিক এখতিয়ারসমুহ নিম্নরূপ –
(I) জেলা জজ আদালত | – আপীল এখতিয়ার ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত (পুর্বে ছিল ৫ লক্ষ টাকা)
– আদি এখতিয়ার নাই। |
(II) অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত | – আদি এখতিয়ার নাই
– জেলা জজ কোন মামলা বদলী করিলে তিনি বিচার করেন। |
(III) যুগ্ম জেলা জজ আদালত | – ২৫ লক্ষ টাকার উর্ধ্ব মূল্যমান (পুর্বে ছিল ৪ লক্ষ টাকা) |
(IV) সিনিয়র সহকারী জজ আদালত | – ১৫,০০,০০১/- থেকে ২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত (পুর্বে ছিল ৪ লক্ষ টাকা) |
(V) সহকারী জজ আদালত | – ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত (পুর্বে ছিল ২ লক্ষ টাকা) |
বর্তমান আর্থিক এখতিয়ারটি ১২ই মে ২০১৭ সালে সংশোধন করা হইয়াছে। কিন্তু ইহা হাইকোর্ট স্থগিত করিয়াছিলেন। পরবর্তীতে ২০২১ সালের আইন দ্বারা পূনরায় সংশোধন করা হইয়াছে বিধায় বর্তমানে উপরে উল্লেখিত আর্থিক এখতিয়ার প্রচলিত আছে।
ডিক্রি জারি
দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর আদেশ ২১ অনুযায়ী ডিক্রি জারি করার জন্য আদালতে আবেদন করা যেতে পারে। আদালত কোন মামলায় ডিক্রি পাশ করলে, যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডিক্রি কার্যকর করার নির্দেশনা থাকে, সেই অনুযায়ী, বিবাদী ডিক্রি কার্যকর না করলে, বাদী ডিক্রি জারি করার জন্য আদালতে আবেদন করতে পারেন।
পর্যালোচনা (Review)
দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ১১৪ ধারা অনুসারে, যদি পক্ষগুলি মামলার বিচার চলাকালীন গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলি সম্পর্কে আদালতকে অবহিত করতে ব্যর্থ হয় বা যদি উল্লিখিত নথিগুলি মামলার নথিতে থাকে কিন্তু ভুল করে প্রমাণিত না হয় বা অন্য কোনো বৈধ কারণে ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হলে, সংক্ষুব্ধ পক্ষ রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আদালতে আবেদন করতে পারে।
পুনর্বিবেচনা (Revision)
নিম্ন আদালতের রায়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষ দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ধারা ১১৫ অনুযায়ী আইন দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উল্লিখিত রায়ের বিরুদ্ধে জেলা জজ আদালতে অতঃপর হাইকোর্টে রিভিশন দায়ের করতে পারে। শুনানি শেষে নিম্ন আদালতের রায় বহাল বা বাতিল হবে।
আপিল (Appeal)
নিম্ন আদালতের রায়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষ দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ৯৬ ধারা মোতাবেক আপিল করতে পারবে।
প্রয়োজনে-
এডভোকেট মুহাম্মদ মহীউদ্দীণ
ঢাকা জজ কোর্ট
01711-068609 / 01540-105088