কোর্ফা, রায়ত, পাট্টা, কবুলিয়ত কি

কোর্ফা কি

 

কোর্ফা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Sublet. সুতরাং শাব্দিক অর্থে কোর্ফা বলতে বুঝায় ভাড়াটিয়া কর্তৃক অপর ভাড়াটিয়ার নিকট ভাড়া প্রদান।

 

যেমন আমরা শহর এলাকায় দেখে থাকি যে, একজন ব্যক্তি বাড়িওয়ালার নিকট থেকে তিন বেড রুমের একটি ফ্লাট ভাড়া নিয়ে সেই ফ্লাটের একটি রুম সে অন্য কোন ব্যক্তির নিকট ভাড়া দেয়। এই ক্ষেত্রে প্রথম ভাড়াটিয়া হচ্ছে রায়ত (Tenant) এবং দ্বিতীয় ভাড়াটিয়া হচ্ছে কোর্ফা (Sublet)

 

কোর্ফা প্রজা কে

১৯৫০ সালে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন (The State Acquisition and Tenancy Act, 1950) পাশ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা গোটা ভারত উপমহাদেশে সরকার বিশাল আকৃতির জমি ইজারা দেওয়ার জন্য সরাসরি প্রজা পত্তন (নিয়োগ) না করে জমিদার বা জোতদার নিয়োগ করতেন। এই জমিদার বা জোতদার আবার সেই জমির মধ্যে কৃষি জমি বা নাল জমির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ চাষাবাদের জন্য রায়ত (বর্গা চাষী) বা তালুকদার নিয়োগ করতেন। এই রায়ত/ তালুকদার আবার তার কৃষি জমি বা নাল জমির কিছু অংশ চাষাবাদের জন্য অন্য কোন ব্যক্তির নিকট দিত। রায়ত যাকে দিত তাকে বলা হয় কোর্ফা প্রজা (Sublet/Sub-lease tenant)। কোর্ফা সম্পত্তি শুধুমাত্র চাষাবাদযোগ্য সম্পত্তি হয়।

 

স্পষ্টভাবে বলা যায় ভাড়াটিয়ার নিকট থেকে ভাড়া নেওয়া অর্থাৎ এক প্রজার অধীন আরেক প্রজা। এই ক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রজা/ ভাড়াটিয়া হলো কোর্ফা চাষী।

 

জমি বন্টন/ ব্যবহারের এই ক্রম নিম্নরূপ–  

সরকার —- জমিদার/জোতদার —- রায়ত/ প্রজা/ তালুকদার —- কোর্ফা প্রজা

 

বর্তমান আইনে কোর্ফা বৈধ কিনা

১৯৫০ সনের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন (The State Acquisition and Tenancy Act, 1950) এর ধারা ১৭(৩)(১) অনুযায়ী, যে দিন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে, সে দিন হতে উক্ত আইনের ৭৫ (ক) (১) ধারা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি তার খাস দখলীয় জমি কোর্ফা পত্তন করার অধিকারী নন। কোন জোতদার বা জমিদার উক্ত তারিখের পর কারো বরাবরে পাট্টা (Lease) প্রদান করলে উক্ত পাট্টা দলিল (Deed of Lease) বাতিল ও অবৈধ বলে গণ্য হবে।

 

সুতরাং কোর্ফা প্রজা যদি কোন জমি হস্তান্তর বা বিক্রয় করিতে চায় তবে অবশ্যই তাহাকে জমিদারের অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি না নিলে ঐ হস্তান্তর বৈধ হবে না।

 

পাট্টা কবুলিয়াত

 

পাট্টা ও কবুলিয়াত, শেরশাহ কর্তৃক প্রবর্তিত একটি অতি পুরানো ভূমি বন্দোবস্তের চুক্তিপত্র। শেরশাহ ভারতবর্ষের সম্রাট (১৫৪০-১৫৪৫) এবং শূর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তার রাজস্ব সংস্কারের মধ্য পাট্টা ও কবুলিয়াত পদ্ধতি অন্যতম। তিনি প্রথমে জমির জরিপের ব্যবস্থা করেন। এই আমলে জমি জরিপের জন্য কানুনগো নিয়োগ দেয়া হয়। জমির উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে রাজস্ব (Revenue) নির্ধারণ করেন। জমির কর্ষণনীতি/ চাষাবাদনীতির (Agricultural Policy) অবস্থা অনুযায়ী ফসলের এক-তৃতীয়াংশ রাজস্ব নির্ধারণ করেন।

 

সম্রাট শেরশাহ এই প্রথা অনুযায়ী কৃষকদের/ প্রজাদের স্বত্ব স্কীকার করে একটি প্রাপ্তি পত্র দিতেন এবং কৃষকদের কাছ থেকে লিখিত চুক্তিপত্র আদায় করতেন। এইভাবে দুইটি চুক্তিপত্র দলিল সম্পাদনের মাধ্যমে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হত। আর এটাই শেরশাহের পাট্টা-কবুলিয়াত প্রথা নামে পরিচিত।

 

পাট্টা

ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য শেরশাহ/ জমিদার, কৃষকদের/ প্রজাদের স্বত্ব স্কীকার করে যে প্রাপ্তি পত্র দলিল দিতেন তাকে পাট্টা দলিল বলা হয়।

 

পাট্টা জমিদার কর্তৃক প্রজা বরাবর সম্পাদিত দলিল। জমিদার কোন কবুলিয়তের প্রেক্ষিতে অথবা অন্য কোন যথোপযুক্ত কারণে প্রজা বরাবর সম্পত্তি (জমি) বন্দোবস্ত দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে তা পাট্টা দলিলের মাধ্যমে সম্পাদন করতে পারতেন।

 

পাট্টা দলিলের বৈশিষ্ট্য

১. জমিদার ও প্রজা উভয়পক্ষের সম্মতিতে পাট্টা দলিলের সৃষ্টি হয়।

২. পাট্টায় জমির চৌহদ্দির/তফসিলের উল্লেখ আছে।

৩. পাট্টায় খাজনার পরিমাণ নির্ধারিত আছে।

৪. কোন পাট্টায় ভোগদখলের মেয়াদ উল্লেখ ছিল।

৫. পাট্টা বাতিলের অধিকার জমিদার কর্তৃক সংরক্ষিত ছিল।

৬. পাট্টা রেজিস্টার্ড অথবা নন-রেজিস্টার্ড হতে ছিল।

 

কবুলিয়াত

কৃষকরা সরকারের নিকট থেকে পাট্টা দলিল পাওয়ার পর সরকার/ জমিদারকে কৃষকরা নির্দিষ্ট রাজস্ব দেওয়ার কথা কবুল (স্বীকার) করে এবং তাদের দাবি ও দায়িত্ব বর্ণনা করে যে চুক্তিপত্র দলিল সরকারকে দিত তাকে কবুলিয়াত দলিল বলা হয়।

 

সম্রাট শেরশাহের শাসনামলে যারা বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে বনভূমিকে চাষের উপযোগী করে গড়ে তুলতেন তাদের প্রজা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার লক্ষ্যে পাট্টা ও কবুলিয়াত পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। পাট্টা হলো কোনো ব্যক্তির জমি ভোগ দখলের অধিকার পত্র। পাট্টার শর্তগুলো মেনে নিয়ে প্রজা যেই সম্মতিপত্র দিতেন তাই কবুলিয়াত।

 

ফেরত পাট্রা দলিল

ক্রেতা ক্রয়মূল্য প্রাপ্তি সাপেক্ষে জমি ফেরত দিবেন বা নির্ধারিত সময় ভোগদখলের পর জমি ফেরত দিবেন এরূপ অঙ্গীকার কোন দলিলে করা থাকলে ঐ দলিলকে একবারনামা বা ফেরত পাট্টা বলা হয়।

 

খাইখালাসি বন্ধক (Usufructuary Mortgage)-

১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ আইনের ৯৫(ক) ধারা প্রবর্তিত হলে ফেরত পাট্টা দলিলের প্রচলন বন্ধ হয়ে যায়। এরূপ অঙ্গীকার সম্পন্ন দলিল সৃষ্টি হলে তা খাই-খালাসি বন্ধক (Usufructuary Mortgage) হিসাবে গণ্য হবে [ধারা ৯৫(ক)]।

 

তালুকদার

তালুকদার শব্দটি ফার্সি শব্দ তালুক (تعلق) এবং আরবি শব্দ দার (دار) শব্দদ্বয়ের মিশ্রণে গঠিত। ফার্সি শব্দ তালুক এর অর্থ ভূমি আর আরবি শব্দ দার এর অর্থ কর্তা। সুলতানি, মোঘল এবং ব্রিটিশ আমলে তালুকের ভূস্বামীদের তালুকদার বলা হতো। তালুকদার বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতে মুসলিম ও হিন্দুদের বংশীয় পদবি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

 

রায়ত (raiyat)-

রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ এর ধারা ২ উপধারা ৯-

“রায়তি কৃষক”(cultivating raiyat) বা “অধীন রায়তি কৃষক” (cultivating under-raiyat) অর্থ এইরূপ রায়ত বা, ক্ষেত্রমত, অধীন রায়ত যিনি স্বয়ং অথবা তাহার পরিবারের সদস্য বা কর্মচারী বা বর্গাদার বা ভাড়াটে শ্রমিক বা সহ-অংশীদারগণের মাধ্যমে চাষাবাদ করিবার জন্য ভূমি অধিকারে রাখেন;

 

জোত

জোত এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Holding. অর্থাৎ নির্দিষ্ট পরিমাণ ভূখন্ডকে বলা হয় জোত। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ এর ধারা ২ এর উপধারা ১৩- মোতাবেক “জোত (holding)” অর্থ ভূমির এক বা একাধিক খণ্ড অথবা উহার একটি অবিভক্ত অংশ যাহা কোনো রায়ত বা অধীন রায়ত কর্তৃক অধিকৃত এবং যাহা কোনো পৃথক প্রজাস্বত্বের বিষয়বস্তু।

 

জোতদার

জোত এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Holding. জোত বলতে বুঝায় জমিদারের অধিনস্ত প্রজার মালিকানাধীন আবাদি বা চাষযোগ্য জমি। সুতরাং এই নির্দিষ্ট পরিমাণ ভূখন্ড বা জোত যে ব্কেযক্তি অধিকারে রাখেন তাকেই বলা হয় জোতদার।

 

নামজারী

ক্রয়সূত্রে বা উত্তরাধিকার সূত্রে কিংবা অন্য কোন সূত্রে জমির নতুন মালিক হলে উক্ত নতুন মালিকের নাম সরকারি খতিয়ানে অন্তর্ভূক্ত করাকে নামজারী বলে।

 

জমা খারিজ

যৌথ জমি বিভক্ত করে আলাদা করে নতুন খতিয়ান সৃষ্টি করাকে জমা খারিজ বলে। অন্যভাবে বলা যায় মূল খতিয়ান থেকে মোট জমির কিছ অংশ নিয়ে নতুন জোত সৃষ্টি করাকে জমা খারিজ বলে।

 

খাস জমি

সরকারের ভূমি মন্ত্রনালয়ের আওতাধিন যে জমি সরকারের পক্ষে কালেক্টর বা ডিসি তত্ত্বাবধান করেন এমন জমিকে খাস জমি বলে।

 

চান্দিনা ভিটি

যেকোন হাট বা বাজারের জন্য স্থায়ী বা অস্থায়ী অকৃষি জমির যে অংশ প্রজার নিকট বরাদ্ধ দেওয়া হয় তাকে চান্দিনা ভিটি বলে।

 

লেখক-

এডভোকেট মুহাম্মদ মহীউদ্দীন (শিশির)

01711-068609

 

যেকোন আইনি জটিলতায় আমাদের অভিজ্ঞ আইনজীবিদের সহায়তা নিতে পারেন।

 

যোগাযোগ-

মহীউদ্দীন এন্ড এসোসিয়েটস

সার্বিক পরিচালনায়- এডভোকেট মুহাম্মদ মহীউদ্দীন (শিশির)

ঢাকা জজ কোর্ট, কোতোয়ালী, ঢাকা অথবা

বনশ্রী, রামপুরা, ঢাকা।

01540-105088 / 01711-068609

Ainbid.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *