চেক ডিজঅনার মামলা করার নিয়ম

চেক ডিজঅনার মামলা করার নিয়ম জানার আগে জানতে হবে চেক ডিজঅনার কি ? চেক ডিজঅনার কি সেটা বুঝতে পারলে চেক ডিজঅনার মামলা করার নিয়মটা বিঝতে সুবিধা হবে।

 

চেক ডিজঅনার কি:

ডিজঅনার বা Dishonour এর শাব্দিক অর্থ হলো অপমান বা অসম্মান। আর চেক ডিজঅনার মানে হলো চেক নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে টাকা না পাওয়া। এটাও এক ধরণের অপমান বলা যায়। অর্থাৎ, আপনি যদি কাউকে কোন টাকা দেন। ঋণ কিংবা ব্যবসা যে উদ্দেশ্যেই হোক। যাকে টাকা দিলেন, সে যদি ঐ টাকার সিকিউরিটি/নিশ্চয়তা বাবদ আপনাকে চেক প্রদান করে। সেই চেক নিয়ে আপনি ব্যাংকে গেলে যদি তার একাউন্টে টাকা না থাকার কারণে কিংবা অন্য যেকোন কারণে ব্যাংক আপনাকে টাকা দিতে না পারে। তাহলে ব্যাংক চেকটি ফেরত দিবে বা প্রত্যাখ্যান করবে। ব্যাংক কর্তৃক চেক ফেরত দেওয়া বা প্রত্যাখ্যান করাই হলো চেক ডিজঅনার।

কি কি কারণে চেক ডিজঅনার হয়:

সাধারণত নিম্নলিখিত কারণে চেক ডিজঅনার হইয়ে থাকে। যথা-

(১) একাউন্টে টাকার অপর্যাপ্ততা,

(২) চেক দাতার স্বাক্ষরের মিল না হওয়া,

(৩) স্বাক্ষর অসম্পূর্ণ,

(৪) চেক দাতা পেমেন্ট স্টপ করে রাখলে,

(৫) অ্যাকাউন্ট ক্লোজ হয়ে থাকলে ইত্যাদি।

 

চেক ডিজঅনার হলে কি করবেন:

যে কারণেই হোক ব্যাংকে কোন চেক ডিজঅনার হলে তা হবে চেক জালিয়াতি বা চেক প্রতারণা এবং এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশে প্রচলিত Negotiable Instrument Act, 1881 (হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১) আইনের ১৩৮ ও ১৪০ ধারা অনুযায়ী চেক ডিজঅনার একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এরূপ প্রতারণার শিকার হলে আপনি Negotiable Instrument Act, 1881 (হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১) আইনের ১৩৮ ও ১৪০ ধারায় প্রতারক ব্যক্তি/ কোম্পানির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে প্রতিকার পেতে পারেন।

 

চেক ডিজঅনার হলে মামলা করার পদ্ধতি:

চেক ডিজঅনারের মামলা করার ক্ষেত্রে তিনটি ধাপ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করতে হবে-

(১) ব্যাংকে চেক উপস্থাপন,

(২) লিগ্যাল/আইনি নোটিশ প্রদান,

(৩) মামলা দায়ের করা।

 

এবার এই ধাপ তিনটি একটু মনোযোগ দিয়ে দেখুন এবং প্রতি ধাপে উল্লেখিত সময় অবশ্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ-

(১) ব্যাংকে চেক উপস্থাপন:

চেকে উল্লেখিত তারিখের ছয় মাসের মধ্যে চেকটি ব্যাংকে উপস্থাপন করতে হবে এবং ব্যাংক থেকে ডিজঅনার স্লিপ নিতে হবে।

 

(২) লিগ্যাল/আইনি নোটিশ প্রদান:

ডিজঅনার স্লিপ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে নিজে অথবা একজন বিজ্ঞ একজন আইনজীবীর মাধ্যমে চেক দাতাকে চেক ডিজঅনার হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে তাকে ৩০ দিন সময় দিয়ে চেকে উল্লিখিত টাকা প্রদানের দাবি জানিয়ে লিগ্যাল নোটিশ দিতে হবে।

 

লিগ্যাল নোটিশ দেওয়ার নিয়ম:

আইন অনুযায়ী লিগ্যাল নোটিশ তিন ভাবে দেওয়া যেতে পারে-

(১) সরাসরি দাতাকে প্রদান করে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই নোটিশের অনুলিপিতে প্রাপ্তি স্বীকারস্বরূপ চেকদাতার (নোটিশ গ্রহীতা) রিসিভ স্বাক্ষর নিতে হবে।

(২) সরাসরি দেওয়া সম্ভব না হলে চেকদাতার বাসস্থানের ঠিকানায় অথবা বাংলাদেশের যে স্থানে সর্বশেষ বসবাস করেছে বা ব্যবসা করেছে সেই ঠিকানায় রেজিস্টার্ড এডিসহ (প্রাপ্তি স্বীকারসহ) ডাকযোগে।

(৩) হুল প্রচারিত যেকোনো একটি জাতীয় দৈনিক বাংলা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে।

 

(৩) মামলা দায়ের করা:

চেক দাতাকে লিগ্যাল নোটিশ দেওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে চেকে উল্লেখিত টাকা না দিলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা ফাইল করতে হবে।

 

কে কোন ধারায় চেক ডিসঅনার মামলা করতে পারবে:

(১) ব্যক্তি কর্তৃক ব্যক্তির বিরুদ্ধে করতে পারবে ১৩৮ ধারায়।

(২) ব্যক্তি কর্তৃক কোম্পানীর বিরুদ্ধে করতে পারবে ১৩৮/১৪০ ধারায়।

(৩) কোম্পানী, ব্যক্তির বিরুদ্ধে করতে পারবে ১৩৮ ধারায়।

কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে শুধু ১৩৮ ধারা উল্লেখ করলেই হবে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হলে এই আইনের ১৩৮ ধারার পাশাপাশি ১৪০ ধারা উল্লেখ করে মামলা করতে হবে।

মামলা দায়ের করার পদ্ধতি:

চেক ডিসঅনার মামলা হলো নালিশি মামলা (CR Case)। চেক ডিসঅনার হলে উপরে উল্লেখিত তিনটি ধাপের শর্ত ও সময় ঠিক থাকলে দরখাস্ত লিখে সকল ডকুমেন্টসহ চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (CMM) অথবা চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (CJM) মামলা করতে হবে। চেকটি যে ব্যাংকে ডিজঅনার হয়েছে, সেই ব্যাংকের এলাকা মহানগর এলাকা হলে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (CMM) আর ব্যাংকের এলাকা মহানগর এলাকার বাহিরে হলে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (CJM) মামলা ফাইল করতে হবে। চেক ডিসঅনার অপরাধের মূল বিচার হবে দায়রা আদালতে। তাই চার্জ গঠনের পর CMM কোর্ট মহানগর দায়রা আদালতে আর CJM কোর্ট জেলা দায়রা আদালতে মামলা বদলী করেন। দায়রা আদালত নিজে বিচার করতে পারেন অথবা তিনি ইচ্ছা করলে যুগ্ম দায়রা আদালতে মামলাটি বিচারের জন্য পাঠাতে পারেন।

 

মামলার আবেদনের সাথে যে সকল ডকুমেন্ট দিতে হবে:

নিম্নলিখিত ডকুমেন্ট মামলার সময় প্রয়োজন হবে-

(১) মূল চেক,

(২) ডিজঅনার স্লিপ,

(৩) লিগ্যাল নোটিশ,

(৪) পোস্টাল রসিদ,

(৫) প্রাপ্তি রসিদ ইত্যাদি।

(৬) বৈধ চুক্তি/লেনদেনের প্রমাণ।

 

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিলেট ডিভিশন কর্তৃক ২০১৭ ইং সনের ৬৩-৬৬ নং ফৌজদারী আপিল মোকাদ্দমাসমূহে মাননীয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চ কর্তৃক প্রদত্ত বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকি কর্তৃক লিখিত সর্বসম্মত রায় অনুযায়ী চেকদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে লেনদেন সম্পর্কিত কোনও বৈধ চুক্তি/লেনদেন প্রমাণ করতে হবে। যেকোন যুক্তিসঙ্গত প্রমাণাদি উপস্থাপন করতে হবে। লেনদেন প্রমাণ হতে পারে ক্রাশ ম্যামো, ভাউচার, ব্যাংকিং লেনদেন, ওয়ার্ক অর্ডার অথবা যেকোন ধরনের বৈধ লেনদেনের প্রমাণ। মূল কথা হচ্ছে যে, বাদীকে প্রমাণ করতে হবে কি কারণে চেকদাতা চেক ইস্যু করেছিল এবং বিবাদীর নিকট বাদীর পাওনা এখনও বলবৎ আছে।

এই ডকুমেন্টগুলোর মূল কপি আদালতে দেখাতে হবে এবং ফটোকপি ফিরিস্তিসহ মামলার দরখাস্তের সাথে সাবমিট করতে হবে।

 

চেক ডিজঅনার অপরাধের শাস্তি:

Negotiable Instrument Act, 1881 (হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১) আইনের ১৩৮ ধারা অনুযায়ী চেক ডিজঅনার অপরাধের শাস্তি এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা চেকে বর্ণিত অর্থের তিন গুণ পরিমাণ অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।

 

আপিলের নিয়ম:

দায়ারা আদালতে কর্তৃক দণ্ডিত হলে আপীল করার সুযোগ রয়েছে। তবে আপিল করার পূর্বে চেকে উল্লেখিত টাকার কমপক্ষে ৫০% টাকা দণ্ড প্রদানকারী আদালত জমা দিতে হবে। এই টাকা জমা ছাড়া আপিল করার সুযোগ নাই।

 

দেওয়ানি আদালতে মামলা:

চেকের গ্রহীতা চেকে বর্ণিত টাকা সম্পূর্ণ বা আংশিক আদায়ের জন্য দেওয়ানি আদালতে মানি মোকদ্দমা (Money suit) করা যায়। এন.আই অ্যাক্টের চেক ডিসঅনার মামলা চলাকালে, এনআই অ্যাক্টের মামলা করার পূর্বে অথবা পরেও মানি মোকদ্দমা করা যায়। চেক ডিসঅনার মামলাটি একটি ফৌজদারি মামলা আর মানি স্যুট একোটি দেওয়ানী মামলা। তাই এই দুইটি আদালতের মামলাই স্বতন্ত্রভাবে পাশাপাশি চলতে পারে।

 

মানি মোকদ্দমার (Money suit) মেয়াদ:

মানি স্যুট করার সময় হলো তিন বছর। অর্থাৎ সর্বশেষ ডিজঅনারের তারিখ হতে তিন বছরের মধ্যে মানি স্যুট করতে হবে।

 

চেক ডিজঅনার মামলা যথাসময়ে করতে না পারলে করণীয়:

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে Negotiable Instrument Act, 1881 (হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১) আইনের অধীনে মামলা দায়ের করতে না পারলে দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৪০৬ এবং ৪২০ ধারা মোতাবেক ফৌজদারী মামলা দায়ের করা যাবে। এইক্ষেত্রে আসামী জামিন নিতে আসলে বিজ্ঞ আদালত টাকা উদ্ধারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন। কিন্তু মামলার শেষে টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ থাকে না। আসামী দোষী সাব্যস্ত হলে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে।

 

আইনগত সহায়তা:

ভূমি বা ফ্লাট নামজারী, দলিল রেজিস্ট্রেশন ও দলিল লিখন, আদালতে ভূমি, ফ্লাট বা অপরাধ সংক্রান্ত মামলা, রাজউক ও হাউজিং কর্তৃপক্ষের অনুমোদন, বাড়ী নির্মাণ ও ডিজাইন কনসালটেন্সি, সংযোগ ও ইউটিলিটি, রিয়েল এস্টেট এজেন্ট (লেটিং এন্ড প্রপার্টি ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস), লিমিটেড কোম্পানী, সমিতি/ট্রাস্ট/ফাউন্ডেশন নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স, ড্রাগ লাইসেন্স, ট্রাভেল এজেন্সী লাইসেন্স, পরিবেশ, বিএসটিআই, ফায়ার লাইসেন্সসহ যেকোন ব্যবসায়িক লাইসেন্স, ভিসা, পাসপোর্ট, ট্যাক্স ও ভ্যাট সংক্রান্ত কাজে আমাদের আইনি সহায়তার জন্য যোগাযগ করুন:

 

জাস্টিস ফোরাম,

সার্বিক পরিচালনা: এডভোকেট মুহাম্মদ মহীউদ্দীন

ঢাকা জজ কোর্ট, কোতয়ালী, ঢাকা।

অথবা

রোড-৫, ব্লক-এ, বনশ্রী, রামপুরা, ঢাকা

01711068609 / 01540105088

ইমেইল: justiceforum@ainbid.com

ওয়েবসাইট: www.ainbid.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *