তত্ত্বাবধায়ক সরকার  ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি

তত্ত্বাবধায়ক সরকার (Caretaker government) ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (Interim Government)

 

তত্ত্বাবধায়ক সরকার (Caretaker government):

তত্ত্বাবধায়ক সরকার হচ্ছে একটি অস্থায়ী সরকার বা অ্যাডহক (Ad hoc) সরকার বা বিশেষ সরকার বা পূর্বপরিকল্পনাবিহীন সরকার। এই সরকার একটি নিয়মিত সরকার নির্বাচিত বা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত নিয়মিত সরকার নির্বাচন বা গঠনের সকল কার্যক্রম পরিচালনা এবং দেশের কতিপয় সরকারি দায়িত্ব ও কার্য সম্পাদন করে। নির্ধারিত ও স্বল্প সময়ের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অস্থায়ীভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে আইন ছিল যা ২০১১ সালে বাতিল করা হয়েছে।

 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (Interim Government):

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও একটি অস্থায়ী সরকার ব্যবস্থা। বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়ে কিছু বলা নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হলো ২০২৪ সালে বাংলাদেশে অসহযোগ আন্দোলনের ফলে ৫ আগস্ট ২০২৪ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সংগঠিত অস্থায়ী সরকারব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নিশ্চিত করেন। সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী সংসদ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করায় মন্ত্রিসভাও ভেঙে যায়। অন্যদিকে, মঙ্গলবার ৬ আগস্ট ২০২৪ সংসদ ভেঙে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। ফলে দেশ পরিচালনার জন্য যে ধরনের সাংবিধানিক সরকার কাঠামো দরকার হয়, সেটি না থাকায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রয়োজন।

 

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশ্য:

তত্ত্বাবধায়ক সরকার  ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি নিয়মিত সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে নির্বাচনের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং দেশের কতিপয় সরকারি দায়িত্ব ও কার্য সম্পাদন করা।

 

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পার্থক্য-

তত্ত্বাবধায়ক সরকার  ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে মৌলিক কিছু পার্থক্য থাকলেও উভয়ের কার্যক্রম প্রায় একই রকম।

 

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈশিষ্ট্য:

তত্ত্বাবধায়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন উভয় সরকারেরই বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ-

(১) অস্থায়ী সরকার,

(২) নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দায়িত্ব নিয়ে থাকে,

(৩) নির্ধারিত কাজ করা,

(৪) স্থায়ী সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা,

(৫) কোন বৈধ ম্যান্ডেট (নির্বাচনী অনুমোদন) থাকে না,

 

সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকার গঠন পদ্ধতি-

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে আগে সংবিধানে বিধান উল্লেখ ছিল। কিন্তু ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ক্ষমতায় থাকা সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ওই সরকারই বিজয়ী রাজনৈতিক দল বা জোটের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।

 

বৈধতা-

নির্বাচন ছাড়াই হঠাৎ করে সরকারের পতন ঘটায় বর্তমানে দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটি বিবেচনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দাবি উঠে। কিন্তু এই বিষয়ে সংবিধানে কিছুই উল্লেখ নাই। সে কারণেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে এক ধরনের আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।

 

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে আগে সংবিধানে বিধান উল্লেখ ছিল। কিন্তু ২০১১ সালে তা তৎকালীন সরকার বাতিল করেন। আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়ে সংবিধানে কোন বিধান উল্লেখ নাই। ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট তুমুল ছাত্র আন্দোলনের ফলে টিকতে না পেরে আওয়ামীলীগ সরকারের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পলায়ন করলে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব সাহাবুদ্দিন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা আছে কিনে এই জন্য আপীল বিভাগে মতামত চান। যার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ, দুর্যোগ মূহুর্তে মধ্যবর্তী সরকার দরকার আছে মর্মে মতামত দিয়ে রুল জারি করেন। সুপ্রিম কোর্টের মতামত পাওয়ার ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি আইনগত বৈধতা সৃস্টি হয়েছে।

 

বাংলাদেশের বর্তমান ২০২৪ এর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাঠামো-

২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে পলায়নের পর উক্ত দিনই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান এর নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র প্রতিনিধি ও দেশের সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে আয়োজিত একটি সভায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে সকলের মতামত নেন। অতঃপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র প্রতিনিধিদের প্রস্তাবিত নাম অনুযায়ী মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ২০২৪ সালের ৮ই আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ও নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে এবং অন্যান্য আরও ১৬ জনকে উপদেষ্টা হিসাবে শপথ পাঠ করান। অতঃপর ২০২৪ সালের ৯ই আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ সকল উপদেষ্টাগণকে মন্ত্রণালয় বন্টন করা হয়।

 

উপদেষ্টাগণ ও তাদের মন্ত্রণালয় নিম্নে উল্লেখ করা হল-

 

প্রধান উপদেষ্টা-

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস,

পরিচয়- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, গ্রামীন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, অর্থনীতিবিদ ও নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী।

প্রাপ্ত মন্ত্রণালয়-

১. মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ; ২. প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়; ৩. সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ; ৪. শিক্ষা মন্ত্রণালয়; ৫. সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়; ৬. খাদ্য মন্ত্রণালয়; ৭. গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়; ৮. ভূমি মন্ত্রণালয়; ৯. বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়; ১০. কৃষি মন্ত্রণালয়; ১১. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়; ১২. রেলপথ মন্ত্রণালয়; ১৩. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়; ১৪. বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়; ১৫. নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়; ১৬. পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়; ১৭. মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়; ১৮. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়; ১৯. তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়; ২০. প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়; ২১. বাণিজ্য মন্ত্রণালয়; ২২. শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়; ২৩. সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়; ২৪. বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়; ২৫. মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়; ২৬. পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়; ২৭. প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়

 

উপদেষ্টাগণ-

(১) জনাব সালেহ উদ্দিন আহমেদ-

পরিচয়- বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর।

প্রাপ্ত মনত্রণালয়- ১. অর্থ মন্ত্রণালয়; ২. পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়

 

(২) ড. আসিফ নজরুল –

পরিচয়- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক।

প্রাপ্ত মনত্রণালয়-  ১. আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়

(৩) জনাব আদিলুর রহমান খান –  ১. শিল্প মন্ত্রণালয়

(৪) জনাব হাসান আরিফ – ১. স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়

(৫) জনাব মোঃ তৌহিদ হোসেন – ১. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

(৬) সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান – ১. পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়

(৭) মিজ শারমীন এস মুরশিদ – ১. সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়

(৮) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন – ১. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

(৯) ড. আ. ফ. ম. খালিদ হোসেন – ১. ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়

(১০) মিজ ফরিদা আখতার – ১. মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়

(১১) মিজ নুরজাহান বেগম – ১. স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়\

(১২) জনাব মোঃ নাহিদ ইসলাম – ১. ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়

(১৩) জনাব আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া – ১. যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়

 

এছাড়াও আরও তিন জন উপদেষ্টা হলেন-

(১৪) ফারুক-ই-আজম (বীর প্রতীক)

(১৫) সুপ্রদীপ চাকমা

(১৬) বিধান রঞ্জন রায়

 

লেখক

এডভোকেট মুহাম্মদ মহীউদ্দীন

01711068609 / 01540105088

ainbid.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *