রীট ও PIL মামলার বিস্তারিত বর্ণনা
রীটের শাব্দিক অর্থ–
রীট (Writ) শব্দটি একটি ইংরেজি শব্দ যার অর্থ হলো লিখন বা আদেশপত্র। Writ এর সমার্থক শব্দ সমূহ হলো writing, permit, mandate, directive, summons, commission, process ইত্যাদি।
রীট (Writ) শব্দটির উৎপত্তি–
রীট (Writ) শব্দটির সর্বপ্রথম হয় উৎপত্তি বৃটেনে। বৃটেনের রাজা বা রানী তাদের কর্মচারী বা কর্মকর্তাদেরকে তাদের দায়িত্ব পালনে বাধ্য করার জন্য অথবা কোন বে-আইনী বা অবৈধ কাজ করা থেকে বিরত রাখার জন্য রীট জারী করতেন। পরবর্তীতে রাজা বা রানীর এই বিশেষাধিকার (Prerogative) নাগরিকদের অধিকারে চলে আসে। অর্থাৎ বৃটেনের নাগরিকগণ সরকারী কর্মকর্তাদের আচরণে ও কাজে সংক্ষুব্ধ (Aggrieved) হলে রাজা বা রানীর কাছে এসে অভিযোগ দিলে রাজা বা রানী বিশেষাধিকারবলে সরকারী কর্মকর্তাদের উপর আদেশ জারি করতো। রাজা বা রানীর এইরূপ আদেশকেই বলা হতো রীট।
আইনের পরিভাষায় রীট–
আইনের পরিভাষায় রীট হলো আদালত বা যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ঘোষিত লিখিত আদেশ। অর্থাৎ উচ্চ আদালতের এমন কোন আদেশ যা দ্বারা আদালত কোন সরকারি কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তিকে কোন কাজ করতে বা করা হতে বিরত রাখার নির্দেশ প্রদান করেন।
রীটের এখতিয়ার বা ক্ষমতা–
বাংলাদেশ সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগকে রিট এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে।
রীট বাংলাদেশের কোন আইনে আছে–
রিট শব্দটি সরাসরি আইনে ব্যবহার করা হয় নাই। তবে বাংলাদেশ সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ ও ৪৪ অনুচ্ছেদে রিটের অধিকার প্রদান করা হয়েছে।
রীট কেন করা হয়–
বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে ১৮ টি মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এই সকল মৌলিক অধিকার লংঘিত হলে ৪৪ অনুচ্ছেদে মামলা করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। ১০২ অনুচ্ছেদে হাই কোর্টকে বিচার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কোন ব্যক্তির মৌলিক অধিকার লংঘিত হলেই কেবলমাত্র রীট করা যায়।
কে রীট আবেদন করতে পারে–
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২(২)(ক) অনুযায়ী সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি নিজে এবং অনুচ্ছেদ ১০২(২)(খ) অনুযায়ী যে কোন ব্যক্তি রীট আবেদন করতে পারে।
কার বিরুদ্ধে রীট আবেদন করা যায়–
সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রীট আবেদন করা যায়। অর্থাৎ সরকারের পক্ষে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, ট্রাইব্যুনাল বা আদালতের বিরুদ্ধে রিট আবেদন করা যাবে।
রিট কত প্রকার–
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগ মৌলিক অধিকার বলবত করার জন্য ৫ ধরণের আদেশ দিতে পারেন। এই অনুচ্ছেদে উল্লেখিত রীটের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে ৫ প্রকারের রীট পাওয়া যায়। যথা-
- Writ of Prohibition বা নিষেধাজ্ঞার রীট(To forbid) – Article 102(2)(a)(I)-
সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে রত কোন ব্যক্তিকে বে-আইনী কাজ করা থেকে বিরত রাখার আদেশ। অর্থাৎ বেআইনী কাজ করেনি কিন্তু করতে উদ্যত হচ্ছে এমন সময় এই রীট জারি করা হয়। হাইকোর্ট বিভাগ কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, ট্রাইব্যুনাল কিংবা আদালতকে বেআইনী কাজ থেকে বিরত থাকার আদেশ এই রীটের মাধ্যমে দিয়ে থাকেন। নিষেধাজ্ঞামূলক রীট হলো প্রতিরোধক (Preventive)।
- Writ of Mandamus বা পরমাদেশ বা হুকুমজারিরীট (We command) – Article 102(2)(a)(I)-
সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে রত কোন ব্যক্তিকে আইন অনুযায়ী কোন কাজ করতে বাধ্য করার আদেশ। কোন অধস্তন আদালত, ট্রাইব্যুনাল, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি তার আইনগত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় কিংবা পালন করতে অস্বীকার করে তাহলে হাইকোর্ট বিভাগ এই হুকুম জারি রীট আদেশ দিয়ে থাকেন।
- Writ of Certiorari বা উৎপ্রেষণরীট (Be certified) – Article 102(2)(a)(II)-
সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে রত কোন ব্যক্তির কৃত কোন কাজ বে-আইনি ঘোষণার আদেশ। অর্থাৎ বেআইনী কাজ করে ফেললে তখন এই রিট জারি করা হয়। কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল, ব্যক্তি বা কোন সংস্থা তার আইনগত ক্ষমতা লংঘন করলে কিংবা Principle of natural justice ভঙ্গ করলে হাইকোর্ট বিভাগ এই আদেশের মাধ্যমে তার উক্ত কাজ নাকচ করে দেন। উৎপ্রেষণ রীট হলো সংশোধক (Curative)।
- Writ of Habeous corpus বা বন্দি প্রদর্শনরীট (Have the body) – Article 102(2)(b)(I)-
বে-আইনিভাবে কোন ব্যক্তিকে আটক করা হলে উক্ত আটক ব্যক্তিকে হাইকোর্ট বিভাগের সামনে হাজির করার আদেশ। নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার। এই স্বাধীনতা বিনষ্ট করে কোন ব্যক্তিকে বে-আইনিভাবে আটক করা হলে কি কারণে তাকে আটক করা হয়েছে তা জানার জন্য বন্দীকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্ট বিভাগ আটককারীকে যে আদেশ দিয়ে থাকেন তাই হলো বন্দী প্রদর্শন রীট বলে।
- Writ of Quo Warrantoবা কারণ দর্শাও রীট (by what warrant or authority) – Article 102(2)(b)(II)-
সরকারি পদে আসীন কোন ব্যক্তি কোন কর্তৃত্ব বলে উক্ত পদে অধিষ্ঠানের দাবি করে তার কারণ দর্শানোর আদেশ। দাবীকৃত সরকারী পদটি অবশ্যই সংবিধান বা আইন দ্বারা সৃষ্ট পদ হতে হবে। সরকারী পদের দাবি অবৈধ প্রমাণিত হলে হাইকোর্ট বিভাগ তাকে পদচ্যুত করার নির্দেশ দিতে পারে।
পাঁচটি ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগে রীট মামলা দায়ের করা যায়। যথা-
ক্রমিক | ক্ষেত্র সমূহ | যে ব্যক্তি রিট করতে পারবে |
১। | বে-আইনী কাজ করা থেকে বিরত রাখার জন্য। | সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি |
২। | আইন অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করার জন্য। | সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি |
৩। | কৃত কোন কাজ বে-আইনি ঘোষণার জন্য। | সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি |
৪। | বে-আইনিভাবে আটক ব্যক্তিকে মুক্তির জন্য। | যেকোন ব্যক্তি |
৫। | সরকারি পদে কোন ব্যক্তি জোরপূর্বক অধিষ্ঠিত থাকলে। | যেকোন ব্যক্তি |
সুতরাং প্রথম তিনটি ক্ষেত্রে রিট করতে পারবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এবং পরবর্তী দুইটি ক্ষেত্রে রিট করতে পারবে যেকোন ব্যক্তি।
কোন ব্যক্তির আবেদন ছাড়া হাইকোর্ট বিভাগ রীট জারি করতে পারবে কিনা-
সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগের স্ব-উদ্যোগে (Suo motu) রীট জারির এখতিয়ার প্রদান করা হই নাই। কিন্তু The Supreme Court of Bangladesh (High Court Division) Rules,1973 এর ১০ বিধিতে বলা হয়েছে কোন পত্র বা তথ্য বা সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের উপর ভিত্তি করে হাইকোর্ট বিভাগ স্ব-উদ্যোগে (Suo motu) রীট জারি করতে পারবে।
নজির-
Tayeeb vs Bangladesh (২০১৫) মামলায় রীটের বিষয়ে আপীল বিভাগ মতামত দেন যে, কোনো ব্যক্তির মৌলিক অধিকার লংঘিত হলে হাইকোর্ট বিভাগ স্ব-উদ্যোগে (Suo motu) রীট জারী করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই জনগণের মারাত্মক ক্ষতি (Great public importance) হতে যাচ্ছে বলে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হতে হবে।
সুতরাং কোন ব্যক্তির আবেদন না করলেও জনগণের মারাত্মক ক্ষতি হতে যাচ্ছে বলে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হলে হাইকোর্ট বিভাগ স্ব-উদ্যোগে (Suo motu) রীট জারি করতে পারবে। হাইকোর্ট বিভাগের এই এখতিয়ারকে বলা হয় Epistolary Jurisdiction ।
জনস্বার্থ মামলা (Public Interest Litigation):
কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন জনস্বার্থে রিট মামলা দায়ের করতে পারে, সরকারি সিদ্ধান্ত বা কার্যক্রম জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হলে সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য রীট আবেদন করা যাবে।
সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান:
কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা সামাজিক সংগঠনের সদস্যদের অধিকার লঙ্ঘিত হলে তারা রিট মামলা দায়ের করতে পারে।
অ্যামিকাস কিউরি (Amicus Curiae):
কোনো বিশেষজ্ঞ বা আইনজীবী যিনি আদালতকে নিরপেক্ষ পরামর্শ দেন এবং কোনো পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করেন না, তারাও আদালতের অনুমতিক্রমে রিট মামলা দায়ের করার জন্য আবেদন করতে পারেন।
লেখক-
এডভোকেট মুহাম্মদ মহীউদ্দীন
01711068609 / 01540105088