তালাক দেওয়ার পদ্ধতি

তালাক কি-

তালাক একটি আরবি শব্দ। ইহার শাব্দিক অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া বা ত্যাগ করা ইত্যাদি। ইসলাম ধর্মের পরিভাষায় আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোকে তালাক বলা হয়। তালাক সংঘটিত হলে স্বামী ও স্ত্রীর পরষ্পরের উপর আর কোন অধিকার ও দায়-দায়িত্ব থাকে না।

 

কে তালাক দিতে পারে-

স্বামী যেকোন সময় স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন। কিন্তু স্ত্রী নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে স্বামীকে তালাক দিতে পারেন।

স্বামী কর্তৃক তালাক: তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে স্বামীকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। স্বামী যেকোন সময় স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন। এমনকি কোন কারণ ছাড়াই স্বামী তালাক দিতে পারেন।

 

স্ত্রী কর্তৃক তালাক: স্ত্রী যেকোন সময় তালাক দিতে পারে না। স্ত্রীকে বিয়ের সময় তালাক দেওয়ার লিখিত অনুমতি দেওয়া হলে কেবলমাত্র তখনই স্ত্রী তালাক দিতে পারেন। বিয়ের সময় কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে স্বামী তার স্ত্রীকে তালাকের অনুমতি দিতে পারেন আবার নাও দিতে পারেন। তবে এই ক্ষেত্রে কাজী সাহেব সাধারণত কিছু জিজ্ঞেস না করেই অনুমতি দিয়ে রাখেন। বিয়ের সময় স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার লিখিত অনুমতি দেওয়া হয় নাই এরূপ ক্ষেত্রেও স্ত্রী তালাক দিতে চাইলে আদালতের মাধ্যমে তালাক দিতে হবে।

 

তালাক দেওয়ার উদ্দেশ্য-

স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যখন এমন চরম বিরোধ দেখা দেয় যে, তাদের আর একত্রে মিলে মিশে স্বামী স্ত্রী হিসেবে শান্তিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। কেবল তখনই ইসলাম এই তালাক পদ্ধতি অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে।

 

তালাকের প্রকারভেদ

পদ্ধতিগত দিক থেকে তালাক তিন প্রকার। যথা-

স্বামী কর্তৃক তালাক: স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত তালাককে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-

 

(ক) তালাকে আহসান

(খ) তালাকে হাসান বা ভালো তালাক এবং

(গ) তালাকে বিদ’আত

বা শরিয়া বিরূদ্ধ তালাক।

 

() তালাকে আহসান বা সর্বোত্তম তালাক তালাক: এক তালাক দেওয়ার পর ইদ্দতকাল অতিক্রম করাকে আহসান তালাক বলে। এই ক্ষেত্রে সহবাস মুক্ত তুহুরে তালাক দিতে হবে এবং এরপর আর কোনো তালাক প্রদান করা যাবে না যে পর্যন্ত না ঐ স্ত্রীর ইদ্দতকাল শেষ না হয় এবং গর্ভবর্তী থাকলে তার গর্ভ ভূমিষ্ট হয়ে যায়।

 

দ্দত: তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী ঋতুবতী হলে তালাক প্রাপ্তির পর থেকে তিন ঋতু পর্যন্ত অথবা ঋতুবতী না হলে তিন মাস বা ৯০ দিন পর্যন্ত সময়কাল বিশেষ নিয়মে অতিবাহিত করাকে ইদ্দত বলে। ইদ্দতকালে অন্য পুরুষকে বিয়ে করা যায় না। কারণ ইদ্দতকালে বিয়ে বহাল থাকে এবং স্বামী চাইলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারেন। এরজন্য কোনো আনুষ্টানিকতার প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে ইদ্দতকালে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী তার ওয়ারিশ হবে।

তুহুর: দুই মাসিকের মধ্যবর্তী সময়কে পবিত্রকাল বা তুহুর বলা হয়)

 

() তালাকে হাসান বা উত্তম তালাক: তালাকে হাসান হলো সহবাস মুক্ত তুহুরে তালাক প্রদান করা। অতঃপর দ্বিতীয় সহবাস মুক্ত তুহুরে দ্বিতীয় তালাক দেয়া। অতঃপর তৃতীয় সহবাস মুক্ত তুহুরে তৃতীয় তালাক প্রদান করা।

(দুই মাসিকের মধ্যবর্তী সময়কে পবিত্রকাল বা তুহুর বলা হয়)

 

() তালাকে বিদআত বা শরিয়া বিরূদ্ধ তালাক: তিন তুহূরের মধ্যে তিন তালাক প্রদান করাকে তালাকে বিদ’আত বলা হয়। একসাথে তিন তালাকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে নিয়ে আর পুনরায় ঘর করা যাবে না। এই তালাক সাথে সাথেই পূর্ণ হয়ে যায়। পুনরায় বিবাহ করে ঘর-সংসার করার আর কোন কোন সুযোগ থেকে না। তবে যদি ভবিষ্যতে উক্ত মহিলার অন্যের সাথে বিবাহের পর পুনরায় সে যদি তালাকপ্রাপ্ত হয় বা তার স্বামী মারা যায়, তাহলে প্রথম স্বামী আবার বিয়ে করতে পারবে।

 

তালাক দেওয়ার পদ্ধতি

স্বামী কর্তৃক তালাক প্রদানের পদ্ধতি:

ইসলামে বর্ণিত পদ্ধতি-

স্বামী যেকোন সময় স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন। এমনকি কোন কারণ ছাড়াই স্বামী তালাক দিতে পারেন। উল্লেখিত পন্থায় স্বামী মুখে উচ্চারণ করেই তালাক দিতে পারেন।

 

বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে বর্ণিত পদ্ধতি-  

বাংলাদেশে ১৯৩৯ সালের বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রিকরণ) আইন ১ঌ৭৪ ও পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫ এর বিভিন্ন বিধানের আলোকে মুসলিম আইনে তালাক কার্যকর হয়ে থাকে।

বর্তমানে তালাক কার্যকর হতে হলে মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ আইনের ৭ ধারার বিধান অনুযায়ী নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে তালাক দিতে হবে-

১। পুরুষ তার স্ত্রীকে তালাক ঘোষণার পরই তালাক দেওয়ার লিখিত নোটিশ চেয়ারম্যান বা মেয়রকে এবং স্ত্রীকে দিবেন।

২। চেয়ারম্যান বা মেয়র  তিন মাসের মধ্যে সালিশ পরিষদ গঠন করবেন, উক্ত সালিশ পরিষদ তাদের পুনর্মিলনের ব্যবস্থা করবেন।

৩। নোটিশ সরবরাহের তারিখ হইতে ৯০ দিন অতিবাহিত হলে উক্ত তালাক কার্যকার হয়ে যাবে। তালাক ঘোষণার সময় স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে গর্ভাবস্থা অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না — ধারা ৭(৫)।

 

তালাকের ক্ষেত্রে নোটিশ দেওয়া বাধ্যতামূলক। নোটিশ না দিলে এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে       —– ধারা ৭(২)।

 

আদালতের মাধ্যমে স্বামী যেভাবে স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন

১. তালাক-ই-তৌফিজের মাধ্যমে।

২. খোলা তালাকের মাধ্যমে।

 

স্ত্রী কর্তৃক তালাক প্রদানের পদ্ধতি:

বিয়ের সময় কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে স্বামী তার স্ত্রীকে তালাকের অনুমতি দিয়ে থাকলে-  স্ত্রীও উপরোক্ত পদ্ধতিতে তালাক দিতে পারবেন।

 

স্ত্রীর তালাকের অনুমতি না থাকলে-

বিয়ের সময় স্ত্রীর তালাকের অনুমতি দেয়া না থাকলে এবং স্ত্রী তালাক দিতে চাইলে আদালতের মাধ্যমে তালাক দিতে পারবেন। এই ক্ষেত্রে আদালতের ডিক্রির কপি চেয়ারম্যানকে দিলেই ৭ ধারার নোটিশ দেওয়ার বিধান প্রতিপালিত হবে।

মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ অনুযায়ী একজন স্ত্রী ৯টি কারণের যে কোনো এক বা একাধিক কারণে আদালতে বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাকের জন্য আবেদন করতে পারবেন। যথা-

১. স্বামী চার বছরের বেশি সময় নিরুদ্দেশ থাকলে,

২. দুই বছর ধরে স্বামী তার স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে,

৩. স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত বিয়ে করলে (১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন),

৪. সাত বছর বা তার বেশি সময় স্বামী কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে,

৫. যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া তিন বছর ধরে স্বামী তার দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে,

৬. বিয়ের সময় পুরুষত্বহীন থাকলে এবং তা বজায় থাকলে,

৭. স্বামী দুই বছর ধরে পাগল থাকলে অথবা মারাত্মক যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত থাকলে,

৮. নাবালিকা অবস্থায় বিয়ে হলে বা সাবালকত্ব লাভের পর, অর্থাৎ ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর স্ত্রী বিয়ে অস্বীকার করলে (কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্বামীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে থাকলে এ রকম মামলা করা যাবে না)—

৯. স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করলে,

 

ক্ষমতা বা এখতিয়ার গত দিক দিয়ে তালাক পাঁচ প্রকার

(১)তালাকে সুন্না

(২) তালাকে বাদী

(৩)তালাকে তাফবীজ

(৪)তালাকে মোবারত ও

(৫)খোলা তালাক।

 

কার্যকর হওয়ার দিক দিয়ে তালাক প্রধানত দুই প্রকার

(১) তালাকে রেজী ও

(২) তালাকে বাইন

তালাকে বাইন আবার দুই প্রকারঃ- (১) বাইনে সগির ও (২) বাইনে কবির।

 

মর্যাদা  অবস্থানের দিক থেকে তালাক চার প্রকার

(১) হারাম

(২) মাকরুহ

(৩) মুস্তাহাব ও

(৪) ওয়াজিব

 

 

তালাকের পর পুনর্বিবাহ

১৯৬১ সালের পূর্বে বাংলাদেশে তালাকের পর পুন বিবাহের ক্ষেত্রে হিল্লা বিবাহের প্রচলন ছিল যা কোরআন হাদিস দ্বারা স্বীকৃত।

 

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ দ্বারা উক্ত শর্তটি রহিত করা হয়েছে। অর্থাৎ তালাকের পর স্বামী ও স্ত্রী যদি পুনরায় একত্রে থাকতে চায় তবে তাদের নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে অন্য কারো সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে না।

 

তালাকের ক্ষেত্রে মোহরানা

মোহরানা স্ত্রীর অধিকার। ইহা থেকে কখনই স্ত্রীকে বঞ্চিত করা যাবে না। তালাকের সঙ্গে স্ত্রীকে তার মোহরানা ও ইদ্দতকালীন সময়ের ভরণ-পোষণ দিতে হবে। স্বামী মোহরানা না দিলে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন। এরূপ মামলা তালাক দেওয়ার তিন বছরের মধ্যে করতে হবে।    (তামাদি আইন)

 

খোলা তালাক-

মুসলিম আইনে স্ত্রীর ইচ্ছায় বিবাহবিচ্ছেদের একটি পদ্ধতি হচ্ছে খোলা তালাক। এ ধরনের তালাক স্বামী ও স্ত্রীর সম্মতিতে হয়ে থাকে এবং ইহা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়। এক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীকে তালাক দেওয়ার প্রস্তাব দেবেন এবং স্বামী ঐ প্রস্তাবে সম্মতি জানাবেন। খোলা তালাকের ক্ষেত্রে অন্য কোনো চুক্তি না থাকলে স্ত্রী মোহরানা পাওয়ার অধিকারী হবেন না। তবে ইদ্দত পালনকালে স্ত্রী তার গর্ভস্থ সন্তানের জন্য স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হবেন।

 

তালাক দেওয়া অতীব জরূরী হয়ে পড়লে আইনি জটিলতা এড়ানোর জন্য অবশ্যই এ বিষয়ে একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নিয়েও পুরো তালাকের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা উচিত।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *