ফ্ল্যট ক্রয়ের পূর্বে এবং ফ্লাট বুঝে পাওয়া পর্যন্ত আপনার যা করা উচিত-
জায়গা-জমির মত ফ্ল্যাটও একটি স্থায়ী সম্পত্তি (Immovable Property). তাই ফ্ল্যাট ক্রয়ের পূর্বে অবশ্যই অন্যন্ত সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে ভবিষ্যত কোনো জটিলতা থেকে মুক্ত থাকার জন্য নিম্নলিখিত পরামর্শগুলো মেনে চলা উচিত:
১। ফ্ল্যাটের অবস্থান (Location of the Flat):
ফ্ল্যাট ক্রয়ের পূর্বে ফ্ল্যাটটি কোথায় অবস্থিত তা দেখা খুবই জরুরি। ফ্লাটের আশেপাশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল, বাজার এবং পরবহন ব্যবস্থা আছে কিনা তা দেখে নিন।
২। পরিবেশ ও নিরাপত্তা (Environment and Security):
উক্ত এলাকার পরিবেশ ভাল কিনা এবং বিশেষ করে বসবাসের জন্য নিরাপদ কিনা তা দেখুন। ফ্লাটটি কোন পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় হলে ভাল হয়।
৩। ফ্লাট নির্মাতা কোম্পানি ও ফ্ল্যাটের বৈধতা:
ফ্লাট নির্মাতা কোম্পানি ইতিপূর্বের কাজের ধরণ ও তাদের প্রকল্পগুলি যাচাই করুন।
৪। দলিলপত্র:
ফ্লাট কেনার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই নিচের কাগজপত্রগুলো বুঝে নিন:
(ক) ডেভেলপার কোম্পানীর সাথে ভূমির মালিকের (Land Lord) চুক্তিপত্র দলিল।
(খ) আমমোক্তারনামা দলিল (Power of Attorney)।
(গ) রাজউকের প্ল্যান পাস ও নকসাটির ফটোকপি।
(ঘ) জমির মূল মালিকের মূল দলিলের ফটোকপি।
(ঙ) জমির মূল মালিকের নামে সিটি জরিপ, আর.এস অনুযায়ী নামজারি খতিয়ান ও জমাভাগ, ডি.সি.আর (ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ) ও হালনাগাদ (Up-to-date) খাজনার রশিদ।
(চ) বায়া দলিলসমূহের ফটোকপি।
(ছ) সকল খতিয়ান (সি.এস, এস.এ, আর.এস, বি.এস এবং ঢাকা মহানগর খতিয়ান) এর ফটোকপি।
(জ) সিটি কর্পোরেশন হোল্ডিং ট্যাক্স এর ফটোকপি।
(ঞ) বিক্রয় দলিল।
৫। দলিলপত্র যাচাই বাছাই:
(ক) কোম্পানীর ফ্লাট বিক্রয় সংক্রান্ত ব্রুশিয়ারের শেষের পৃষ্ঠায় Terms & Condition ভালভাবে পড়ুন।
(খ) ফ্লাট বুকিং নিয়ে কিস্তিতে কিনতে চাইলে “নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে” চুক্তি সম্পাদন করে বুকিং মানি ও ডাউন পেমেন্টের টাকা দিন।
(গ) বুকিং মানি ও ডাউন পেমেন্টের টাকাসহ সকল ধরণের টাকা অবশ্যই কোম্পানীর ব্যাংক একাউন্টে একাউন্ট পেয়ি চেক/ব্যাংক ড্রাফ্টে/ পে-অর্ডারের মাধ্যমে পরিশোধ করুন। পে-অর্ডার বা চেকে কোম্পানীর নাম লিখে দিন।
(ঘ) চুক্তিপত্রে পে-অর্ডার বা চেক নম্বর, একাউন্টের নাম, একাউন্ট নম্বর, ব্যাংকের নাম, তারিখ, ফ্লাটের মূল্য, ফ্লাট হস্তান্তরের তারিখ ইত্যাদি বর্ণনা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।
(ঙ) উল্লেখিত ফ্লাটের সকল লিগ্যাল পেপারস এর এক সেট ফটোকপি বুঝে নিন।
(চ) ৪ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখিত কাগজপত্রের কোনটি কম থাকলে কোন তাড়াহুড়া না করে সেটি সংগ্রহ করার পর ফ্ল্যাট বুকিং দিন।
(ছ) ডেভেলপার কোম্পানী ফ্লাট বিক্রয়ের চুক্তিপত্রটি সাধারণত ইংরেজিতে করে থাকে। এটি কোন সমস্যা নয়। তবে আপনার বুঝতে সমস্যা হলে চুক্তিপত্রটি বাংলায় করতে বলে দিন। অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় ডেভেলপার কোম্পানী ইংরেজি চুক্তিপত্রের অনেক টার্মসে বা শর্তেই খুব সুক্ষভাবে কিছু ফাঁক ফোকর রেখে দেয়, যা নিরিহ ফ্ল্যাটক্রেতা অনেক ধরতে পারেনা বা খেয়াল করেন না। ফলে পরবর্তীতে কোন সমস্যা হলে, সেই টার্মসটির বা শর্তটির কারণে ফ্ল্যাটক্রেতা কিছুই করতে পারে না।
৬। চুক্তিপত্রে যে বিষয় গুলো অবশ্যই উল্লেখ থাকা উচিত:
চুক্তিপত্র বাংলায় বা ইংরেজী যে ভাষায়ই হোক না কেন, চুক্তিনামায় নিম্নলিখিত শর্তগুলো উল্লেখ আছে কি না তা দেখে নিন-
(ক) চুক্তিনামায় আপনার এবং ডেভেলপার কোম্পানীর কর্তা ব্যক্তির (যার সাথে ভূমি মালিকের চুক্তি ও আম-মোক্তার নামা হয়েছে) নাম, বাবা ও মায়ের নাম, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, ধর্ম, পেশা, ভোটার আইডি কার্ডের নম্বর, মোবাইল নম্বর ইত্যাদি।
(খ) রাজউক কর্তৃক প্ল্যান পাসের নাম্বার ও তারিখ।
(গ) ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা লেনদেনের বিবরণ।
(ঘ) ফ্ল্যাটের মূল্য, কার পার্কিং মূল্য (যদি কার পার্কিং থাকে), ইউটিলিটি বা অন্যান্য মূল্য ইত্যাদি। সবগুলোর মূ্ল্য পৃথকভাবে চুক্তিতে লিখতে হবে।
(ঙ) ফ্ল্যাট হস্তান্তরের নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করতে হবে।
(চ) জমির মালিকের সাথে ডেভেলপার কোম্পানীর চুক্তিপত্রে ফ্লাটটি কবে বসবাস উপযোগী করে হস্তান্তর করার কথা রয়েছে, সেই তারিখের সাথে আপনাকে ফ্ল্যাট হস্তান্তরের তারিখের মিল আছে কি না, তা দেখে নিন।
(ছ) নির্ধারিত তারিখে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করতে না পারলে, সেই তারিখের পর ফ্ল্যাটভাড়া আপনাকে কত করে দিবে, তা উল্লেখ আছে কি না দেখুন এবং ফ্লাট হস্তান্তরের সময় কতদিন বর্ধিত করা যাবে তা আলোচনা করে ঠিক করুন।
(জ) যথাসময়ে আপনি কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পারলে কি হবে সেটিও লিখে রাখা উচিত।
(ঝ) “ফ্ল্যাট মালিক সমিতি” এর জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমান টাকা ধরা হয়। উক্ত টাকার পরিমান অন্যান্য ফ্লাট মালিকদের ন্যায় একই রকম কিনে সেটি জেনে নিন।
(ঞ) চুক্তিনামায় কিস্তির টাকা পরিশোধের একটি তফসিল বা সিডিউল (Payment and Working Schedule) থাকা উচিৎ। উক্ত সিডিউলে টাকা পরিশোধের প্রত্যেক তারিখে নির্মাণ কাজের অগ্রগতি কতটুকু হবে তার একটি বর্ণনা থাকা উচিৎ এবং পেমেন্ট সিডিউলে “ফ্লাটের নির্মাণ কাজের অগ্রগতির উপর পেমেন্ট নির্ভরশীল থাকবে” -এমন একটি কথা চুক্তিনামায় উল্লেখ করে নেয়া ভাল।
(ট) ডেভেলপার কোম্পানী ফ্ল্যাটে কি কি নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করবে তা চুক্তিনামায় অবশ্যই স্পষ্ট বর্ণনা থাকতে হবে।
(ঠ) চুক্তিনামায় ফ্ল্যাটটি নির্দিষ্ট করে তফসিলের বর্ণনা এবং ফ্লাটের সাথে ভূমির কতটুকু অংশ থাকবে তার একটি সঠিক ও নির্দিষ্ট বর্ণনা থাকতে হবে।
(ড) আপনার বুকিংকৃত ফ্ল্যাটটি যে তলায় অবস্থিত সেই তলা পর্যন্ত রাজউক কর্তৃক অনুমোদিত (প্ল্যান পাসকৃত) কিনা, রাজউকের প্ল্যানে যে তলায় যতটি ইউনিট অনুমোদিত আছে, ডেভেলপার কোম্পানী সেই তলায় ততটি ইউনিটই নির্মাণ করছে কিনা সেই বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। তা না হলে, পরবর্তীতে ইউটিলিটি অর্থাৎ গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি সংযোগে এবং দলিল রেজিষ্টি করতে অথবা ফ্ল্যাটের বিপরীতে লোন পেতে খুবই সমস্যায় পড়তে হতে পারে।
৭। চুক্তি পরবর্তি কাজ:
(ক) চুক্তিনামায় উল্লেখিত কিস্তির টাকা পরিশোধের সিডিউলের প্রত্যেক তারিখে ফ্লাটের নির্মাণ কাজের অগ্রগতি যে পরিমাণ হওয়ার কথা সেই পরিমাণ কাজ কোম্পানী করছে কিনা তা টাকা দেওয়ার সময় খেয়াল করুন।
(খ) ডেভেলপার কোম্পানী সিডিউল অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন না করলে কোম্পানীকে মৌখিকভাবে জানান এবং এ/ডি সহ রেজিষ্ট্রিকৃত চিঠির মাধ্যমে জানান।
(গ) আপনি যেই ফ্লাটটি কিনবেন সেটির মালিক “পাওয়ার অব এর্টনি” দলিল মতাবেক কে তা দেখে নিতে হবে এবং যে জমির উপরে এপার্টমেন্টটি নির্মাণ হচ্ছে, সেই জমির “পাওয়ার অব এর্টনির” তফসিল এবং আপনার চুক্তিনামার তফসিল মিলিয়ে দেখুন।
(ঘ) চুক্তিনামাটি অবশ্যই রেজিষ্টি করে নিতে হবে। কারণ রেজিস্ট্রি করে না নিলে উক্ত দলিল আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না।
লেখক–
এডভোকেট মুহাম্মদ মহীউদ্দীন
01711-068609
যেকোন আইনি সহায়তার প্রয়োজন হলে আমাদের অভিজ্ঞ আইনজীবিগণের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
যোগাযোগ-
মহীউদ্দীন এন্ড এসোসিয়েটস
সার্বিক পরিচালনায়- এডভোকেট মুহাম্মদ মহীউদ্দীন (শিশির)
১৬, কৈলাশঘোষ লেন, ঢাকা জজ কোর্ট, ঢাকা। অথবা
রোদ-৫, ব্লক-এ, বনশ্রী, রামপুরা, ঢাকা।
মোবাইল- 01711-068609 / 01540-105088
ইমেইল- info@ainbid.com
ওয়েবসাইট- ainbid.com