যে ক্ষেত্রে মানুষ হত্যা আইনত অপরাধ নয়
অথবা
ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার (Right of Private Defence)
হত্যা সাধারণত অপরাধ বলেই গণ্য হবার কথা। কিন্তু কতিপয় ক্ষেত্রে হত্যা করলেও তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না। অর্থাৎ এরূপ ক্ষেত্রে একজন মানুষকে হত্যা করার পরও হত্যাকারী কোন শাস্তি পাবে না।
আইনের আলোকে বর্ণনা–
বাংলাদেশে প্রচলিত আইন দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৪র্থ পরিচ্ছেদের ৯৬ থেকে ১০৬ ধারায় ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার (Right of private defence) প্রদান করা হয়েছে। এখানে ধারা ১০০ এবং ১০৩ অনুযায়ী একজন ব্যক্তি শরীর ও সম্পত্তি রক্ষার্থে ১০টি ক্ষেত্রে হত্যা সংঘটন করলেও তা অপরাধ বলে গন্য হবে না এবং এর জন্য নরহত্যা সংঘটনকারী ব্যক্তিকে কোনো প্রকার শাস্তি দেওয়া হবে না।
দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ১০০ ধারা–
শরীর রক্ষার জন্য নিম্নলিখিত ৬ টি ক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটালে অপরাধ হবে না।
(১) নিহত করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করলে (Assault with intention to death): কোন ব্যক্তির আক্রমণের জন্য মৃত্যু অনিবার্য হলে সেই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আক্রমণকারীর মৃত্যু ঘটালে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না।
(২) গুরুতর আহত করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করলে (Assault with intention to grievous hurt): কোনো ব্যক্তির আক্রমণের ফলে গুরুতর আঘাতের (Grievous Hurt) আশঙ্কা দেখা দিলে উক্ত আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আক্রমণকারীর মৃত্যু ঘটালে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না। কোনো আঘাত কোন কোন ক্ষেত্রে গুরুতর আঘাত বলে গণ্য হবে তার বর্ণনা রয়েছে দন্ডবিধির ৩২০ ধারায়-
দন্ডবিধির ধারা ৩২০: গুরুতর আঘাতের সংজ্ঞা (Grievous Hurt).
গুরুতর আঘাতের উপাদান ৮ টি। অর্থাৎ যেকোন আঘাতই নিম্নলিখিত ৮টি ক্ষেত্রে গুরুতর আঘাত হবে-
- পুরুষত্বহীন করণ (Emasculation)
- চোখের দৃষ্টিশক্তি স্থায়ীভাবে নষ্টকরণ
- কানের শ্রবণশক্তি স্থায়ীভাবে নষ্টকরণ
- অঙ্গ বা গ্রন্থির অনিষ্ট সাধন
- অঙ্গ বা গ্রন্থির কর্মশক্তি হরণ
- মাথা বা মুখমন্ডল স্থায়ীভাবে বিকৃতকরণ
- দন্ত বা অস্থি ভঙ্গ বা স্থানচ্যুত করণ
- ২০ দিন পর্যন্ত প্রচন্ড দৈহিক যন্ত্রনা ভোগ।
(৩) ধর্ষণের উদ্দেশ্যে আক্রমণ (Assault with intention to rape): ধর্ষণের আশঙ্কা দেখা দিলে উক্ত ধর্ষণ প্রতিরোধ করার জন্য ধর্ষণের আক্রমণকারীকে হত্যা করা হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
(৪) অস্বাভাবিক কামলালসার উদ্দেশ্যে আক্রমণ (Assault with intention to unnatural lust): কোনো নারী বা পুরুষকে অপ্রাকৃতিক কামলালসার শিকার করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হলে উক্ত আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য আক্রমণকারীর মৃত্যু ঘটানো হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
(৫) অপহরণের উদ্দেশ্যে আক্রমণ (Assault with intention to kidnapping or abducting): অপহরণের উদ্দেশ্যে আক্রমণ করলে উক্ত উক্ত আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য আক্রমণকারীর মৃত্যু ঘটানো হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
(৬) অবৈধ আটক উদ্দেশ্যে আক্রমণ (Assault with intention to wrongful confinement): কোন ব্যক্তিকে অবৈধভাবে আটক করার জন্য আক্রমণ করা হলে, উক্ত আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য আক্রমণকারীর মৃত্যু ঘটানো হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ১০৩ ধারা–
সম্পত্তি রক্ষার জন্য নিম্নলিখিত ৪ টি ক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটালে অপরাধ হবে না।
(৭) দস্যুতা প্রতিরোধে (Robbery): কোন সম্পত্তির উপর দস্যুতাকারী আক্রমণ করলে উহা প্রতিরোধ করার জন্য দস্যুতাকারীর মৃত্যু ঘটালে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
(৮) রাতে ঘর ভেঙে অনুপ্রবেশ করলে (House breaking at night): রাতে দরজা বা জানালা ভেঙে কিংবা সিঁধ কেটে অনুপ্রবেশ করলে তার হাত থেকে সম্পদ রক্ষার জন্য উক্ত অনুপ্রবেশকারীর মৃত্যু ঘটালে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
(৯) গৃহ, তাবু বা যানবাহনে অগ্নিসংযোগ প্রতিরোধে (Mischief by fire on house, tent or vessel): কোন গৃহ, তাবু বা যানবাহনে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করার জন্য উক্ত অগ্নিসংযোগকারীর মৃত্যু ঘটালে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
(১০) চুরি, ক্ষতি বা অনধিকার প্রবেশের ফলে মৃত্যু বা গুরুতর আঘাতে আশংকা থাকলে (Theft, mischief of house-trespass when causing death or grievous hurt): কোন সম্পদ চুরি, ক্ষতি বা অনধিকার গৃহ প্রবেশের ফলে কারও মৃত্যু বা গুরুতর আঘাতের আশঙ্কা থাকলে উক্ত অপরাধীর মৃত্যু ঘটালে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
এছাড়াও ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৪৬(৩) ধারায় আরেকটি ক্ষেত্রে হত্যা করা হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৪৬(৩) ধারা-
(১১) মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডযোগ্য আসামীর গ্রেপ্তার নিশ্চিত করার জন্য অপরাধকারীকে হত্যা করা হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
উল্লেখিত ১১টি ক্ষেত্র ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করে হত্যা সংঘটিত করা হলে তা অবশ্যই দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে।
ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার প্রয়োগের সীমা-
দণ্ডবিধির ৯৯ ধারায় ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার প্রয়োগের সীমা উল্লেখ করা হয়েছে। এই ধারা মোতাবেক আত্মরক্ষার জন্য যতদুর পর্যন্ত ক্ষতিসাধন করা প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করা যাবে না। ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার মূলনীতি হচ্ছে, আঘাত যতটুকু প্রতিঘাতও ততটুকু। অর্থাৎ কোনোভাবেই আক্রমণের সীমা অতিক্রম করে প্রতি-আক্রমণ করা যাবে না।
ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার প্রয়োগের স্থিতিকাল-
দণ্ডবিধির ১০২ এবং ১০৫ ধারা মোতাবেক আক্রমণের আশংকা দেখা দিয়ে ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার প্রয়োগের সময় শুরু হয়ে যায় এবং আতংক কেটে গেলেই আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগের সময় শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং আতংক যতক্ষণ আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগের স্থিতিকালও ততক্ষণ।
মতামত-
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ১০০ ও ১০৩ ধারায় এবং ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৪৬(৩) ধারায় উল্লেখিত ব্যতিক্রিম ছাড়া অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে হত্যাকারী অবশ্যই অপরাধী বলে গণ্য হবে।
প্রমাণের দায়িত্ব কার-
সাদাহ্রণত ফৌজদারি মামলায় অভিযোগকারীকেই কৃত অপরাধটি প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার কেউ দাবি করলে সেই ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২-এর ১০৫ ধারা মোতাবেক ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার এর দাবিকারীকেই প্রমাণ করতে হবে যে, ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার প্রয়োগেই ক্ষতি করা হয়েছে।
লেখক–
এডভোকেট মুহাম্মদ মহীউদ্দীন
01711068609 / 01540105088
ainbid.com