কারফিউ কি

কারফিউ কি এবং বাংলাদেশে ইহার আইন

 

কারফিউ সম্মন্ধে যে বিষয়গুলো জানবো-

(১) কারফিউ কি

(২) কোন আইনে কারফিউ পরিচালিত হয়

(৩) কারফিউ এর আদেশ কে দিতে পারে

(৪) কারফিউ এর কারণে সংবিধান লংঘন হয় কিনা

(৫) কারফিউ ও ১৪৪ ধারার পার্থক্য

(৬) কারফিউ লংঘন করলে সরাসরি গুলি  করা যায় কিনা

 

(১) কারফিউ বা সান্ধ্য আইন (Curfew) কি:

 

কারফিউ (Curfew) এর শাব্দিক অর্থ-

কারফিউ (Curfew) একটি ইংরেজি শব্দ যার উৎপত্তি হয়েছে ফরাসি (French) শব্দ Couvre-feu থেকে।  Couvre অর্থ to cover বা ঢেকে ফেলা এবং feu অর্থ হছে আগুন। সুতরাং কারফিউ এর শাব্দিক অর্থ আগুন ঢেকে ফেলা বা অগ্নিনির্বাপণ। কারফিউ শব্দটির উৎপত্তির পর থেকে শুরুর দিকে Curfeu হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে এটির বানান কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে Curfew হয়। এক সময় আগুনের প্রদীপ থেকে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধের জন্য রাত ৮টার মধ্যে সকল আগ্নিশিখা ও আগুনের প্রদীপ নিভিয়ে ফেলার নিয়ম ছিল। এই কারণে কারফিউকে “সান্ধ্য আইন” ও বলা হয়ে থাকে।

 

সুতরাং কারফিউকে বা “সান্ধ্য আইন” -এর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে সন্ধ্যায় বা সন্ধ্যার পর চলাচলের বিশেষ বিধান। কিন্তু কারফিউকে “সান্ধ্য আইন” বলা হলেও এটি যে শুধুমাত্র রাতের বেলায় বলবত থাক তা নয়। বর্তমানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ইহা সারাদিনের যেকোন সময় বলবত রাখা যায়।

 

আইনের পরিভাষায় কারফিউ এর অর্থ

আইনের পরিভাষায় কারফিউ এর অর্থ হচ্ছে, কারফিউ এমন এক প্রকার আইন যেখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিশেষ ধরনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে।

 

(২) কোন আইনে কারফিউ বা সান্ধ্য আইন পরিচালিত হয়- 

স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ (Special Power Act, 1974) এর মাধ্যমে ‘কারফিউ’ বা ‘সান্ধ্য আইন’ প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের ২৪ ধারায় কারফিউ বা সান্ধ্য আইনের বিধান বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। যথা-

 

ধারা ২৪ সান্ধ্য আইন:

কোন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা মহানগর এলাকায় পুলিশ কমিশনার, সরকারের নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে আদেশ জারির মাধ্যমে নির্দেশ দিতে পারেন যে, আদেশে নির্দিষ্ট ব্যতিক্রম বাদে, আদেশে নির্দিষ্ট এলাকা বা এলাকাসমূহে উপস্থিত কোন ব্যক্তিই আদেশে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তির মনজুরীকৃত লিখিত অনুমতিপত্রের প্রাধিকার ব্যতীত ঘরের বাহিরে আসিতে পারিবে না।

 

(২) এই ধারা অনুসারে দেওয়া আদেশ যদি কোন ব্যক্তি লঙ্ঘন করে তবে তাহার এক বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডই হইতে পারে।”

 

বিধি-নিষেধ-

কারফিউ বলবত থাকা অবস্থায় নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তির লিখিত অনুমতি ব্যতীত, ঘরের বাহিরে যাওয়া যাবে না।

 

কারফিউ ভঙ্গের শাস্তি-

বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এর ২৪(২) ধারা মোতাবেক কারফিউ ভঙ্গের শাস্তি এক বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডই হতে পারে।

 

কারফিউ জারির উদ্দেশ্য-

কোনও এলাকায় দাঙ্গা বা হাঙ্গামার ভয়ঙ্কর রূপ দেখা দিলে যদি পুলিশ সাভাবিকভাবে জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে অসমর্থ হয় তখন কারফিউ এর আদেশ জারি করা হয়। সমস্যার মাত্রার উপর ভিত্তি করে কাউফিউয়ের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়। কারফিউ অনির্দিষ্টকালের জন্যও জারি হতে পারে।

 

(৩) কারফিউ এর আদেশ কে দিতে পারে / আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা-

বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ অনুযায়ী সরকারের নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে ‘কারফিউ’ বা ‘সান্ধ্য আইন’ এর আদেশ দিতে পারেন,

মহানগরীর বাহিরে – জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (District Magistrate)

মহানগরী এলাকায় – পুলিশ কমিশনার (Police Commissioner)

 

(৪) কারফিউ এর কারণে সংবিধান লংঘন হয় কিনা- 

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৩৯  অনুচ্ছেদে সকল জনগনকে চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা প্রদান হয়েছে।

 

জনগনের এই সকল স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। কিন্তু সন্দেহজনক, অভিযুক্ত কিংবা অপরাধীকে ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৫৪ ও ৫৫ ধারায় উল্লেখিত ক্ষেত্রে আটক বা গ্রেপ্তার করা যাবে। তবে যেকোন আটকের ক্ষেত্রে অবশ্যই সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদের বিধান অনুসরণ করতে হবে।

 

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ: গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ (Safeguards as to arrest & detention).

(১) গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেফতারের কারণ জানাতে হবে। আইনজীবীর সাথে পরামর্শ ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।

(২) গ্রেফতারের ২৪ ঘন্টার মধ্যে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে।

(৩) বিদেশী শত্রু বা নিবর্তনমূলক আইনের অধীন গ্রেফতার করলে ৬ মাসের মধ্যে উপদেষ্টা পর্ষদের সামনে হাজির করতে হবে।

 

সুতরাং কারফিউ এর কারণে জনগণ কতিপয় মৌলিক অধিকাররের সুবিধা থেকে সাময়িকভাবে বঞ্চিত হলেও ইহা বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে পরিচালিত হয় বিধায় কারফিউ এর ফলে সংবিধান লংঘন করা হয়েছে বলা যায় না।

 

(৫) কারফিউ ও ১৪৪ ধারার পার্থক্য-

কারফিউ  ১৪৪ ধারা
(১) কারফিউ আছে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ এর ২৪ ধারায়। (১) ১৪৪ ধারা আছে ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ১৪৪ ধারায়।
(২) কারফিউ সরকারের নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে জারি হয়। (২) ১৪৪ ধারা সরকারের নিয়ন্ত্রণে জারি হয় না
(৩) কারফিউ জারি করেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ কমিশনার। (৩) ১৪৪ ধারা জারি করেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
(৪) কারফিউ সারা দেশে কিংবা নির্দিষ্ট স্থানের জন্য জারি হতে পারে। (৪) ১৪৪ ধারা শুধুমাত্র মহানগরের বাহিরে জারি হয়।
(৫) কারফিউ লংঘনে শাস্তির বিধান বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ এর ২৪(২) ধারায়। (৫) ১৪৪ ধারা লংঘনে শাস্তির বিধান দন্ডবিধির ১৮৮ ধারায়।
(৬) শাস্তি ১ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ড। (৬) শাস্তি ৬ পর্যন্ত কারাদন্ড বা ১০০০/- অর্থদন্ড বা উভয়দন্ড।
(৭) সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ করা যায়। (৭) সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ করা যায় না।
(৮) সরাসরি গুলি করা যায়। (৮) সরাসরি গুলি করা যায় না।

 

(৬) কারফিউ চলাকালে সরাসরি গুলি করা যাবে কিনা-  

বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এ সরাসরি গুলি করার কোন বিধান নাই। তবে “Farid Ahmed Versus East Pakistan” মামলায় পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট (21 DLR 225) আদেশ প্রদান করেন যে, গনশান্তি ও জনজীবন রক্ষার্থে সিভিল অথরিটিকে সহায়তার জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে আহ্বান করা যাবে এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় কারফিউ লংঘনকারীকে দেখা মাত্র গুলি করা যাবে।

 

লেখক

এডভোকেট মুহাম্মদ মহীউদ্দীন

01711068609 / 01540105088

ainbid.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *