দুর্নীতি কি-
দুর্নীতি হলো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার মধ্যে দায়িত্বশীল ব্যক্তির দ্বারা ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ অর্থ আদায় ইত্যাদি। দুর্নীতির বিভিন্ন ধরণ রয়েছে। যথা-
১। ঘুষ(bribery)- অর্থ বা উপহার দিয়ে অবৈধ সুবিধা লাভের চেষ্টা করাই হলো ঘুষ।
২। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি(Corruption in appointment): ঘুষ অথবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের মাধ্যমে নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিয়োগ পাওয়া।
৩। সরকারি সম্পত্তির অপব্যবহার (Misuse of govt property): সরকারি সম্পদ ও বিভিন্ন সুবিধাদি অবৈধভাবে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কাজে ব্যবহার করা।
৪। তথ্য গোপন (Concealing information): জনস্বার্থের প্রয়োজনীয় তথ্য গোপন করে অন্যায়ভাবে বিভিন্ন সুবিধা লাভ করা।
৫। জালিয়াতি(Forgery): ভুয়া বা জাল দলিল বা কাগজপত্র ব্যবহার করে আর্থিক বা অন্যান্য সুবিধা অর্জন করা।
৬। প্রভাব লেনদেন (Influence peddling/ traffic of influence/ trading in influence)- বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে লেনদেন করা।
৭। আত্মসাৎবা তছরুপ (Embezzlement)- সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎবা তছরুপ করা।
৮। এমনকিছু অভ্যাসও জড়িত থাকতে পারে যা অনেক দেশে বৈধ।
দুর্নীতি সমাজ ও দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন ও সচেতনতা বৃদ্ধি করে এর মোকাবিলা করা সম্ভব।
বাংলাদেশে দুর্নীতির বর্তমান অবস্থা–
বাংলাদেশের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুর্নীতি বিদ্যমান রয়েছে যার কিছু চিত্র নিম্নে তুলে ধরা হলো-
১। ঘুষ গ্রহণ ও প্রদানে দুর্নীতি: সরকারি ও বেসরকারি সেক্টরে সেবা পাওয়ার জন্য ঘুষ দেওয়া এবং নেওয়ার ঘটনা প্রচলিত। এটি বিশেষ করে সরকারি অফিস, পুলিশ বিভাগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ও স্বাস্থ্যসেবায় বেশি দেখা যায়।
ক্ষমতার অপব্যবহার: রাজনৈতিক নেতারা এবং সরকারি কর্মকর্তারা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেন এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে সরকারি সম্পদ ব্যবহার করেন।
প্রকল্প তহবিলের অপচয়: উন্নয়ন প্রকল্প এবং সরকারি ক্রয়ে অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে বা কাজের মান হ্রাস করে প্রকল্পের তহবিলের অপচয় করা হয়।
চাঁদাবাজি ও কালোবাজারি: কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক ও অন্যান্য কার্যক্রমে চাঁদা দাবি করা হয় এবং বাজারে পণ্য সরবরাহ ও মূল্যে নিয়ন্ত্রণ করে কালোবাজারি করা হয়।
নিয়োগ ও পদোন্নতিতে দুর্নীতি: বিভিন্ন চাকরি এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে ঘুষ বা প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ এবং পদোন্নতি দেওয়া হয়।
তথ্য ও পরিসংখ্যানের জালিয়াতি: সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর রিপোর্ট ও পরিসংখ্যান জালিয়াতি করা হয়, যা প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করে।
আর্থিক দুর্নীতি: ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঋণ প্রদানে অনিয়ম, অর্থপাচার, এবং ব্যাংকের তহবিলের অপব্যবহার ঘটে।
টেন্ডার ও দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি: সরকারি ও বেসরকারি টেন্ডার ও দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটিয়ে এবং অনিয়মিতভাবে চুক্তি প্রদান করা হয়।
বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতি: মামলা পরিচালনা এবং রায় প্রদানে দুর্নীতি, ঘুষ গ্রহণ, এবং প্রভাব খাটানো ঘটে।
শিক্ষা খাতে দুর্নীতি: ভর্তি প্রক্রিয়া, পরীক্ষার ফলাফল প্রভাবিত করা, এবং সার্টিফিকেট কেনাবেচার ঘটনা ঘটে।
এই সব ধরণের দুর্নীতি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে ব্যাহত করে এবং সাধারণ মানুষের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া এবং এটি সফল করতে হলে সরকার, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, এবং সাধারণ জনগণকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
দুর্নীতি কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়-
দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায় উল্লেখ করা হলো:
১। আইনি ব্যবস্থা ও শাস্তি কঠোর করা:
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা। দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত ও যথাযথ শাস্তি প্রদান।
২। প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি:
সরকারি ও বেসরকারি খাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
৩। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা:
সব পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। সরকারের কাজের সব তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখা এবং জনগণকে সংশ্লিষ্ট কাজে অন্তর্ভুক্ত করা।
৪। সুশাসন ও নীতি:
সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণ করা।
৫। তদারকি ও নজরদারি:
সরকারি ও বেসরকারি কার্যক্রমে তদারকি ও নজরদারি বৃদ্ধি করা এবং দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে তা দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৬। সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের ভূমিকা:
সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে উৎসাহিত করা। দুর্নীতির ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে আনা ও জনমত গঠন করা।
৭। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংস্থাগুলির প্রতিষ্ঠা:
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য স্বাধীন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন।
৮। অর্থনৈতিক সংস্কার:
অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সংস্কার আনা এবং ব্যবসা পরিচালনার নিয়মকানুন সহজ করা, যাতে দুর্নীতির সুযোগ কমে যায়।
৯। প্রযুক্তির ব্যবহার:
ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, যেমন ই-গভর্নমেন্ট, ই-প্রোকিউরমেন্ট ইত্যাদি, যা প্রশাসনিক কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে সহায়ক।
১০। নৈতিক শিক্ষার প্রসার:
শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক ও মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান করা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে পারে।
দুর্নীতি প্রতিরোধ একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং এর জন্য সরকারি, বেসরকারি, এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
লেখক-
এডভোকেট মুহাম্মদ মহীউদ্দীন
01711-068609